বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন

পদে না থেকেও সব ছিল পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণে

পদে না থেকেও সব ছিল পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণে

স্বদেশ ডেস্ক:

বিদেশে পলাতক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কোনো পদে ছিলেন না। তারপরও তিনি ফাস ফাইন্যান্সের বোর্ডসভায় উপস্থিত থাকতেন।

পিকে হালদারের নির্দেশে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণের অঙ্ক বসিয়ে ফাইল উপস্থাপন করা হতো ফাস ফাইন্যান্সের বোর্ডসভায়। পিকে হালদারের ফাইল বলা হলেই বোর্ডের সবাই তা যাচাই-বাছাই না করে অনুমোদন করে দিত। এরপর পিকে হালদারের নির্দেশমতো অনুমোদিত ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হিসাবে না পাঠিয়ে পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠানো হতো। ফাস ফাইন্যান্সের সবই ছিল পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জসিম উদ্দিনের আদালতে গতকাল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ার। এর আগে দুদকের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন তিনি।

এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছে দুদক। গতকাল সংস্থার উপপরিচালক মো. আব্দুল মাজেদ বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা ১-এ মামলাটি করেন।

দুদকের তথ্যমতে, ফাস ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এর মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধানে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্যপ্রমাণ পেয়ে ১৩টি মামলা করা হয়। প্রতিটি মামলায় ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেল শাহরিয়ার ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পিকে হালাদারকে আসামি করা হয়েছে।

দুদকের তথ্যমতে, ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান এন্ড বি ট্রেডিং নামে ৪৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলা করে দুদক। মামলার পর ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি মো. রাসেল শাহরিয়ারকে রাজধানীর মোহাম্মদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করে দুদক। আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। মামলার বাদী দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান তাকে রিমান্ডে নিয়ে ২ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিসেট্রট জসিম উদ্দিনের আদালতে হাজির করেন। আদালতে তিনি দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে রাসেল শাহরিয়ার বলেন, ২০০৫ ইউনাইটেড লিজিং এবং ২০০৬ সালে আইআইডিএফসিতে যোগদান করেন তিনি। সেখানে তার হেড ছিলেন পিকে হালদার। ২০০৮ সালে পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি পদে যোগদান করেন। তিনি ২০১৪ সালে পিকে হালদার ও তার সহযোগী উজ্জল কুমার নন্দীর নির্দেশে ফাস ফাইন্যান্সের এমডি হিসেবে যোগদান করেন। ওই সময় ফাস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান ছিলেন এমএ হাফিজ। পরিচালক ছিলেন উজ্জল কুমার নন্দী, জাহাঙ্গীর আলম ও সিদ্দিকুর রহমান। তারাই ফাস ফাইন্যান্সের বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করতেন। পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী উজ্জল কুমার নন্দী ও নাহিদা রুনাই প্রায় আমাকে ফোন করে বলতেন পিকে হালদারের ফাইল পাঠাচ্ছি, এটা তাড়াতাড়ি বোর্ডে দেন। এসব ফাইল নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। এগুলো বোর্ডের দায়িত্ব, আপনি নির্ভয়ে কাজ করেন।

জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, ক্রেডিট বিভাগের হেড হিসেবে প্রাণ গৌরাঙ্গ দে যোগদান করার পর উজ্জল কুমার নন্দী ফোন দিয়ে ঋণসংক্রান্ত ফাইলগুলো বোর্ডে নিয়ে যেতে বলতেন। করপোরেট হেড হিসেবে আহসান হাবীব যোগদানের পর তারাই সরাসরি পিকে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইলগুলো বোর্ডে নিয়ে আসতেন। পিকে হালদারের নির্দেশমতে বোর্ডের ফাইল উপস্থাপনের জন্য নোটশিট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করা হতো এবং আমাকে বোর্ডে উপস্থাপনের জন্য বলত পিকে হালদার আমাদের চেম্বারে তিনবার এসেছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি ফাস ফাইন্যান্সের বোর্ডসভায়ও উপস্থিত থাকতেন। বোর্ডে কোনো ফাইল উপস্থাপনের পর বলা হতো এটি পিকে হালদারের ফাইল, তার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডের সবাই এক বাক্যে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফাইল অনুমোদন করে দিত।

তিনি জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, পিকে হালদারের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম, বাসুদেব ব্যানার্জী, নওশেরুল আলম, সিদ্দিকুর রহমান ও উজ্জল কুমার নন্দী। পিকে হালদার সিন্ডিকেটই ফাস ফাইন্যান্স লুটের সঙ্গে জড়িত। আমি পিকে হালদার, উজ্জল কুমার নন্দী সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলমের চাপেই কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই কোনো মর্টগেজ না নিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে একক স্বাক্ষরে কিছু ফাইল বোর্ডে উপস্থাপন করি। বোর্ড অনুমোদন দিলে পিকে হালদার ও উজ্জল কুমার নন্দীর নির্দেশমতো অনুমোদিত ঋণ হিসেবে অর্থ না পাঠিয়ে পিকে হালদারের সংশ্লিষ্ট হিসাবে ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। ঋণপ্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাদের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব থেকে সরাসরি ঋণগ্রহীতাদের অনুকূলে চেক প্রদান করার রীতিনীতি থাকলেও পিকে হালদারের নির্দেশে অর্থের গতিপথ আড়াল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ করা হয়।

জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরিয়ার কেমিক্যাল লিমিটেড, মীম ট্রেডিং করপোরেশন, কনিকা এন্টারপ্রাইজ, মুন এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, বর্ণ, উইনটেল এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠান, সন্দীপ করপোরেশন, সুখাদা প্রপার্টিজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টাপ্রাইজ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে পিকে হালদারের আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীদের। এ ছাড়া এমএসটি ফার্মা এন্ড হেলথ কেয়ার, এমার এন্টারপ্রাইজ, মেরিন এন্টারপ্রাইজ, এমটিবি মেরিন ট্রাস্ট হলো নওশেরুল আলম ও বাসুদেব ব্যানার্জীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যার ব্যবসায়িক পার্টনার হলো পিকে হালদার। অন্য অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলো পিকে হালদারের আত্মীয়স্বজন ও তার সহযোগীদের।

দুদক সূত্র বলছে, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই মর্টগেজ গ্রহণ ব্যতীত প্রায় ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণপ্রদানের নামে ফাস ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল শাহরিয়ারের একক স্বাক্ষরে আত্মসাৎ হয়েছে ৭০০ কোটি। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্যপ্রমাণ পেয়ে ১৩টি মামলা করা হয়েছে।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফাস ফাইন্যান্স থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণগ্রহণ করা পিকে হালদারের ২২টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের ২০টিই ভুয়া। শুধু কাগজপত্রে প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। দুদকের অনুসন্ধানী টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০টি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় এর কোনো অস্তিত্ব পায়নি। বাস্তবে যে ২টি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে, সেগুলোও বন্ধ। দুদকের অনুসন্ধানী টিম ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে ঋণপ্রদানকারী ফাস ফাইন্যান্সের সহকারী ম্যানেজার মো. নুরুল আমিনকে সঙ্গে নিয়ে দুদকের চার সদস্যের একটি টিম গত বছর দুই সপ্তাহ সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০টি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পায়নি। ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরাও তাদের বাসায় থাকে না, কেউ কেউ আবার বিদেশে পলাতক। সবার মোবাইল নম্বর বন্ধ। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই।

দুদক সূত্রে জানা যায়, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফাস ফাইন্যান্স।

ফারইস্ট ফাইন্যান্সের সাবেক এমডিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সংস্থার উপপরিচালক মো. আব্দুল মাজেদ বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা ১-এ মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন- ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তনু সাহা, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মো. হাফিজুর রহমান, সাবেক সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুন নাহার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আহসানুল ইসলাম, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব আইসিসিডি তানভীর হাসান, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট বিপ্লব সাহা এবং সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি শেখ খালেদ জহির।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে এ. হোসেন অ্যান্ড কোম্পানিকে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডভাইজার হিসেবে দেখালেও প্রকৃত অর্থে কোম্পানিটি ফারইস্টের ট্যাক্স অ্যাডভাইজার নয়। তারপরও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের সুদ দেওয়ার নামে ওই সুদ প্রদান খাত থেকে টাকা উত্তোলন করে এবং নির্দিষ্ট ব্যাংকে জমা প্রদান না করে এ. হোসেন অ্যান্ড কোম্পানির নামে ১০টি চেকের মাধ্যমে ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৭০ টাকা দেয়। পরবর্তী সময়ে ওই টাকা আত্মসাৎ করে স্থানান্তর, পাচার, প্লেসমেন্ট ও লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করেছেন আসামিরা। তাদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877